মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের রাজাকার নেতা শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড এবং রাজাকার খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক। রাজাকার সিরাজ মাস্টার কসাই সিরাজ হিসেবে পরিচিত।
রায়ে বলা হয়েছে, রাজাকার আসামি সিরাজের বিরুদ্ধে আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামি সিরাজকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে দণ্ড কার্যকর করা হোক। অন্যদিকে তিনটি অভিযোগের মধ্যে একটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে রাজাকার আকরামের বিরুদ্ধে। তাই আকরামকে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলার সাতটি অভিযোগের প্রথম ছয়টি অভিযোগে রাজাকার সিরাজের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম পাঁচ অভিযোগ হচ্ছে- হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর রাজাকার আকরামের বিরুদ্ধে ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগের মধ্যে প্রথম দুটি অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে প্রসিকিউশন। তবে ৭ নম্বর অভিযোগে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রসিকিউশন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রাজাকার সিরাজ বাগেরহাট সদরের মির্জাপুর গ্রামের গোটাপাড়া গ্রামের হারেজউদ্দিন শেখ ও সালেহা বেগমের ছেলে। একসময় তার গ্রামের লোক তাকে সিরাজ মাস্টার নামে ডাকত। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেয়নেট দিয়ে গলা কেটে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেন সিরাজ। তাই স্বাধীনতার পর তাকে কসাই সিরাজ নামে অভিহিত করে স্থানীয় জনগণ। তিনি রাজাকার বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর একেএম ইউসুফের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। রাজাকার শিরোমণি ইউসুফ বিচার চলাকালীন অসুস্থ হয়ে মারা যান।
অন্যদিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আকরাম হোসেন ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জয়নাল আবেদীন খান, আর মা জুলেখা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন আকরাম। বাগেরহাট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নেন।
রাজাকার সিরাজ ও আকরামের নামে যেসব অভিযোগ : অভিযোগ এক : ১৯৭১ সালের ১৩ মে রাজাকার বাহিনীর বাগেরহাট সাব-ডিভিশনের তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন রাজাকার বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। সেদিন সিরাজ ও তার সহযোগীরা ৪০-৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করেন।
অভিযোগ দুই : ১৯৭১ সালের ২১ মে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাগেরহাটের রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে ২-৩ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী একত্রিত হন। সেদিন সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে তার লোকজন ওই কালী মন্দিরে হামলা করে ৬-৭শ’ জনকে হত্যা করে।
অভিযোগ তিন : ১৯৭১ সালের ১৮ জুন বাগেরহাটের বেসরগাতী, কান্দাপাড়া বাজার থেকে ২০ জনকে অপহরণ করেন সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগী সশস্ত্র রাজাকাররা। নির্যাতন করে ১৯ জনকে হত্যা করেন সিরাজ ও তার লোকজন।
অভিযোগ চার : ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর বাগেরহাটের সদর থানার চুলকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৫০টি বাড়িঘর লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করে সিরাজের লোকজন। সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাতজনকে হত্যা করেন সিরাজসহ তার লোকজন।
অভিযোগ পাঁচ : ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর সিরাজ মাস্টার, রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ ৫০-৬০ জন রাজাকার বাগের কচুয়া থানার শাঁখারিকাঠি গ্রামের ৪০ জন হিন্দু এবং দুই স্বাধীনতা সমর্থককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন।
অভিযোগ ছয় : ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর বাগেরহাটের কচুয়া থানার কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে অপহরণ করে হত্যা করেন সিরাজ ও তার সহযোগীরা।
অভিযোগ সাত : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে নির্যাতন করে হত্যা করে আকরাম ও লতিফের লোকজন।
ফাঁসির রায়ে বাগেরহাটে উল্লাস : শওকত আলী বাবু বাগেরহাট থেকে জানান, কুখ্যাত রাজাকার কসাই সিরাজ মাস্টারের ফাঁসি ও তার সহযোগী আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়ায় আনন্দ মিছিল করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। রায় ঘোষণার পরপরই বাগেরহাট পুরনো কোট চত্বর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে ফেটে পড়েন। তারা উল্লাস প্রকাশ করে রাজাকার সিরাজ মাস্টারের ফাঁসি অবিলম্বে কার্যকরের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এসে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পরে মিছিলে যোগ দেন বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মুুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল বাগেরহাট শহর প্রদক্ষিণ করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার শাঁখারিকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় কুখ্যাত এ রাজাকার কমান্ডারসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি ২১তম রায়। এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ আদালতে আপাতত আর কোনো মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ থাকল না।
গত বছরের ২৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাগেরহাটে এসে তিন দিন ধরে তদন্ত করেন। তদন্তকালে কর্মকর্তারা মামলার বাদী ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়ার সময় কসাই সিরাজের বিরুদ্ধে আটশতাধিক হত্যা-গণহত্যার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন।
২০১৪ সালের ১০ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর ২১ জুলাই রাত ১১টায় বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রাম থেকে এই কুখ্যাত রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়। ওই রাতে তিনি তার চাচাশ্বশুর মৃত মোসলেম পাইকের পরিত্যক্ত একটি খুপড়ি ঘর রাত্রিযাপন করার সময়ে বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ সিরাজ মাস্টারকে ধরতে সক্ষম হয়। এর আগে বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানা পুলিশ গত বছর ১১ জুন পলাতক আসামি আবদুল লতিফ তালুকদারকে এবং ১৯ জুন রাজশাহী থেকে আকরাম হোসেন খানকে গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করে।
কে এই কসাই সিরাজ : ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণকারী বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা একেএম ইউসুফের বামহস্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী সিরাজুল হক খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ও রাজাকার বাহিনীর তৎকালীন বাগেরহাট মহাকুমা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীয় বাগেরহাট পিচ কমিটির নেতা রজব আলী ফকির, শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং আকিজ উদ্দিন ছিলেন অন্যতম ক্ষমতাধর। বাগেরহাটের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ছিল রাজাকারদের অন্যতম ঘাঁটি। ভৈরন নদীর পাশে এ বাংলো হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার নীরিহ মানুষকে ধরে এনে রাতে বাংলোয় বসেই অত্যাচার করতেন সিরাজ ও তার অনুসারীরা। সকালে ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে প্রবাহিত বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদীর পাড়ে নিয়ে কসাই সিরাজ নিজ হাতে জবাই করে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। তার আগে তাদের বুক চিরে কলিজা বের করে দেখতেন। কুখ্যাত কসাই সিরাজ প্রতিদিন সকালে নিজ হাতে মানুষ জবাই না করে নাস্তা পর্যন্ত করতেন না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজ মাস্টার বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলা ঘাটে মুক্তিকামী শত শত মানুষকে ধরে এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করার কারণে রাতারাতি সিরাজ মাস্টার কসাই সিরাজ মাস্টার হিসেবে কুখ্যাতি পান। স্বধীনতার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম খোকনের ‘রফিক বাহিনী’র যোদ্ধারা এই কুখ্যাত কসাই সিরাজ মাস্টারকে আটক করে। একই সময়ে আটক করা হয় রাজাকার আকিজ উদ্দিনকেও। তখন বাগেরহাট শহরে টিকিটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কুখ্যাত এই দুই রাজাকারকে লোহার খাঁচায় আটকে রেখে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখন কসাই সিরাজ মাস্টারকে দেখে তার গায়ে থুথু মেরে ঘৃণা প্রকাশ করত সাধারণ মানুষ। দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি ছিলেন এই রাজাকার। পরে তিনি মুক্তি পান। মুক্তিও পর নিজ এলাকা গোটাপাড়া গ্রামে ফিরে আসেননি। পরে বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বাড়ি করে সেখানে বসবাস করতেন। মুক্তি পাওয়ার পর কসাই সিরাজ দম্ভোক্তি করে বলতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, হলে আমি সিরাজ মাস্টার বাংলাদেশের আলো-বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না।
Leave a Reply